অসম ভূমিকম্প ২০২৫ (Assam Earthquake 2025)
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করেই উত্তর-পূর্ব ভারতের অসমে আঘাত হানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে কম্পনমাত্রা ধরা পড়ে ৫.৮। উৎসস্থল ছিল অসমের গুয়াহাটি ও তেজপুরের মাঝে অবস্থিত ওদালগুরি জেলা। এই ভূমিকম্পে সরাসরি প্রভাব পড়ে অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। তার জেরে কম্পন অনুভূত হয় কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি-সহ গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে। এমনকি মৃদু কম্পন টের পাওয়া গিয়েছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়।
ভূমিকম্প কীভাবে হয়? (বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ) অসম ভূমিকম্প ২০২৫ (Assam Earthquake 2025)
ভূমিকম্প হল পৃথিবীর ভূত্বকের আকস্মিক আন্দোলন।
- পৃথিবীর ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন টেকটোনিক প্লেট।
- এই প্লেটগুলো সবসময় নড়াচড়া করে। যখন দুটি প্লেটের মধ্যে চাপ বাড়তে থাকে এবং হঠাৎ ভেঙে যায়, তখন বিশাল এনার্জি মুক্তি পায়।
- সেই এনার্জিই ভূ-পৃষ্ঠে এসে ভূমিকম্প তৈরি করে।
এই ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে—
- ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে অসম অবস্থিত।
- এই অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বহুদিন ধরেই পরিচিত।
- বিজ্ঞানীরা এটিকে Seismic Zone V (সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকম্প জোনগুলির একটি) হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
অসমের ওদালগুরি: উৎসস্থল অসম-ভূমিকম্প-২০২৫-(assam-earthquake-2025)
এইবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল অসমের ওদালগুরি।
- গুয়াহাটি থেকে প্রায় ৭৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই জেলা।
- ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল প্রায় ১০ কিমি।
- অগভীর গভীরতায় হলে কম্পন অনেক বেশি শক্তিশালীভাবে উপরে পৌঁছায়। তাই উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।
উত্তরবঙ্গে কম্পনের প্রভাব Assam Earthquake
ভূমিকম্প শুরু হতেই উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
- শিলিগুড়ি: বহু মানুষ বহুতল আবাসন থেকে রাস্তায় নেমে আসেন।
- কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি: বাড়িঘরের দরজা-জানলা কেঁপে ওঠে।
- দার্জিলিং: পাহাড়ি এলাকায় কম্পনের ভয় আরও বেশি। অতীতে বড় ভূমিকম্পের স্মৃতি মানুষের মনে ফিরে আসে।
- আলিপুরদুয়ার: সীমান্তবর্তী এলাকাতেও মানুষ মাটির কম্পন স্পষ্টভাবে অনুভব করেছেন।
কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের প্রতিক্রিয়া Assam Earthquake
যদিও কম্পন ছিল মৃদু, তবুও—
- কলকাতা, হাওড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান-এর একাংশে কম্পন টের পাওয়া যায়।
- বহুতল অফিসবিল্ডিং ও আবাসনে বসে থাকা মানুষরা চেয়ার বা ফ্যান কাঁপতে দেখে আতঙ্কিত হন।
- অনেকে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে খবর খোঁজতে থাকেন।
অতীতের ভূমিকম্পের ইতিহাস
উত্তর-পূর্ব ভারত বহুবার বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সাক্ষী হয়েছে।
- ১৮৯৭ সালের শিলং ভূমিকম্প – রিখটার স্কেলে ৮.১, উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম ভূমিকম্প।
- ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প – রিখটার স্কেলে ৮.৬, এটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প।
- সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বারবার অনুভূত হয়েছে, বিশেষত অসম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে।
সাধারণ মানুষের আতঙ্ক ও প্রতিক্রিয়া Assam Earthquake
এইবারের ভূমিকম্পে—
- মানুষ হঠাৎ সব কাজ ফেলে রাস্তায় ছুটে আসেন।
- হাসপাতাল, স্কুল, অফিসেও সাময়িক আতঙ্ক ছড়ায়।
- বহু মানুষ সামাজিক মাধ্যমে খবর শেয়ার করতে থাকেন।
- কেউ কেউ পুরনো ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের কথা স্মরণ করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ : অসমের ভূমিকম্প নিয়ে গভীর মূল্যায়ন Assam Earthquake
অসম ও উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প নিয়ে গবেষক ও ভূতত্ত্ববিদরা নতুন করে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। রিখটার স্কেলে ৫.৮ মাত্রার এই কম্পন আপাতদৃষ্টিতে খুব বড় মনে না হলেও, বিজ্ঞানীদের মতে এর প্রভাব ভবিষ্যতের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে একটি। ভূতত্ত্ববিদরা বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প প্রায়শই ঘটে এবং অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো আসন্ন বড় ভূমিকম্পের সংকেত বহন করে। নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।
উত্তর-পূর্ব ভারতের সিসমিক জোন Assam Earthquake
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, উত্তর-পূর্ব ভারত Seismic Zone V-এ অবস্থিত। এটি ভারতের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প জোন।
- এখানে ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেট এবং ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেট একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করছে।
- এই সংঘর্ষের কারণে ভূত্বকের নিচে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়।
- চাপ যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই ভূমিকম্প ঘটে।
তাদের মতে, ভূমিকম্প প্রতিবারই সেই চাপকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারে না। ফলে বারবার কম্পন হলেও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা থেকেই যায়।
ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্পের ভূমিকা Assam Earthquake
ভূতত্ত্ববিদরা বারবার বলেছেন—
- ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়।
- অনেক সময় এগুলোই ইঙ্গিত দেয় যে ভূগর্ভে চাপ জমছে।
- ভূমিকম্পের মাত্রা যতটা দেখা যায়, তার থেকেও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে ভবিষ্যতে যদি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে।
অসম-উত্তরবঙ্গের ঝুঁকি : ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা
অসম ও উত্তরবঙ্গ ভৌগোলিকভাবে এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যা পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। ভূতত্ত্ববিদরা একে Seismic Zone V অর্থাৎ ভারতের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর প্রধান কারণ হলো ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষের ফলে ভূত্বকের নিচে প্রচণ্ড চাপ জমা হয়, যা সময় সময় মুক্ত হয়ে ভূমিকম্পের জন্ম দেয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অতীতে এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছে, যার ক্ষয়ক্ষতি আজও মানুষের মনে আতঙ্ক জাগায়।
অতীতের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প Assam Earthquake
১৮৯৭ সালের শিলং ভূমিকম্প
১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভোরবেলায় উত্তর-পূর্ব ভারতের শিলং অঞ্চলে আঘাত হানে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প।
- রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.১।
- ভূমিকম্পের প্রভাবে গোটা আসাম, শিলং, এমনকি উত্তরবঙ্গের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- শত শত মানুষ প্রাণ হারায় এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে যায়।
- তখনকার সময় প্রযুক্তিগত দিক থেকে মানুষ এতটা প্রস্তুত ছিল না, তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি ছিল।
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প
১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের দিনে, আসাম আবারও কেঁপে ওঠে।
- এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৬, যা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প।
- উৎসস্থল ছিল অরুণাচল প্রদেশ-আসাম সীমান্ত এলাকা।
- ভূমিকম্পের জেরে বিশাল ভূমিধস হয়, ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং প্রচুর প্রাণহানি ঘটে।
- ভূমিকম্পের পরে বহু জায়গায় নদী প্লাবিত হয়, গ্রাম-শহর ভেসে যায়।
ইতিহাসের শিক্ষা Assam Earthquake
বিজ্ঞানীরা বলেন, ইতিহাস প্রমাণ করে যে উত্তর-পূর্ব ভারত ও উত্তরবঙ্গের ভূগর্ভে প্রচণ্ড চাপ জমে থাকে এবং কয়েক দশক অন্তর ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প ঘটে। ১৮৯৭ ও ১৯৫০ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধান ছিল। এই তথ্য থেকে গবেষকরা মনে করেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে আবারও বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বর্তমান ঝুঁকি Assam Earthquake
বর্তমান সময়েও ছোট-বড় ভূমিকম্প নিয়মিতভাবে অনুভূত হচ্ছে—
- ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে অসমের ওদালগুরিতে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে উত্তরবঙ্গ ও কলকাতা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
- গত কয়েক বছরে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ ও আসামে মাঝারি মাত্রার কম্পন রেকর্ড করা হয়েছে।
- এগুলো বিজ্ঞানীদের মতে আসন্ন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিতবাহী হতে পারে।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা Assam Earthquake
ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন—
- উত্তরবঙ্গ ও অসম সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
- অতীতে যেমন ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছে, ভবিষ্যতেও বড় আঘাত আসতে পারে।
- নিয়মিত ছোট ভূমিকম্পগুলো আসলে ভূগর্ভে চাপ জমার লক্ষণ।
- এই পরিস্থিতিতে প্রশাসন, নগর পরিকল্পনা এবং সাধারণ মানুষকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।
করণীয় Assam Earthquake
সাধারণ মানুষকে সচেতন করা।ক দশক অন্তর অন্তর বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেই কারণে নিয়মিত ছোট ভূমিকম্পগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি করা।
স্কুল, অফিস ও আবাসনে নিয়মিত মহড়া চালানো।
উদ্ধারকারী বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা Assam Earthquake
- ভবন নির্মাণের নিয়ম মানা জরুরি – ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় মজবুত ও ভূমিকম্প-সহনীয় নির্মাণ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
- মানুষকে সচেতন করা দরকার – কীভাবে ভূমিকম্পের সময় আচরণ করতে হবে, তা স্কুল-কলেজে পড়ানো উচিত।
- প্রশাসনের প্রস্তুতি – উদ্ধারকারী বাহিনী, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও জরুরি ত্রাণসামগ্রী সবসময় প্রস্তুত রাখা জরুরি।
- নিয়মিত মনিটরিং – ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে সক্রিয় রাখতে হবে, যাতে যেকোনও ছোট কম্পনের বিশ্লেষণ করে আগাম সতর্কতা দেওয়া যায়।
ভবিষ্যতের সতর্কতা ও করণীয়
ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষতি কমানো সম্ভব—
- ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন নির্মাণ জরুরি।
- স্কুল ও অফিসে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া (Drill) চালানো উচিত।
- সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে—
- ভূমিকম্প হলে দ্রুত খোলা জায়গায় চলে যাওয়া।
- লিফট ব্যবহার না করা।
- টেবিল বা শক্ত আসবাবের নিচে আশ্রয় নেওয়া।
- প্রশাসনের উচিত—
- দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (NDRF) সবসময় প্রস্তুত রাখা।
- ত্রাণ ও উদ্ধার সামগ্রী মজুত রাখা।
One thought on “অসমের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল গোটা উত্তরবঙ্গ! রিখটার স্কেলে কম্পনমাত্রা ৫.৮, মৃদু প্রভাব কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গেও”