Health Commission guideline বাংলার হাসপাতালগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক পরিবারের অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল—রোগীর মৃত্যুর পরও হাসপাতাল মৃতদেহ আটকে রাখে, যতক্ষণ না পরিবার সমস্ত বিল মিটিয়ে দেয়। এই ধরনের ঘটনা শুধুমাত্র আইনি ও নৈতিক দিক থেকেই নয়, মানবিক দিক থেকেও অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। অবশেষে, পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য কমিশন (West Bengal Health Commission) সোমবার এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে—রোগীমৃত্যুর পর কোনওভাবেই অর্থের জন্য দেহ আটকে রাখা যাবে না।
এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, চিকিৎসা মহল এবং প্রশাসনিক মহলে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। এবার দেখে নেওয়া যাক, কমিশনের নির্দেশিকায় কী বলা হয়েছে, কেন এই নির্দেশিকার প্রয়োজন দেখা দিল এবং এর সামাজিক ও আইনি গুরুত্ব কতটা।
স্বাস্থ্য কমিশনের নতুন নির্দেশিকা Health Commission guideline
সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ
স্বাস্থ্য কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে—
- রোগীর মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব পরিবারের হাতে দেহ তুলে দিতে হবে।
- সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহ ছেড়ে দিতে হবে।
- কোনওভাবেই টাকা-পয়সা বা বিলের অজুহাতে দেহ আটকে রাখা যাবে না।
বিল মেটানোর প্রক্রিয়া
কমিশন জানিয়ে দিয়েছে—
- হাসপাতাল চাইলে মৃত্যুর পর বিল মেটানোর জন্য পরিবারের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনায় বসতে পারে।
- কিন্তু দেহ আটকে রেখে টাকা আদায় করার অধিকার কোনও হাসপাতালের নেই।
- প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে বিল মেটাতে হবে, কিংবা আইনি প্রক্রিয়া চালু করা যাবে।
কেন এই নির্দেশিকার প্রয়োজন? Health Commission guideline
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বহুবার খবরের শিরোনাম হয়েছে—মৃতদেহ আটকে রাখা হয়েছে অর্থের জন্য। এতে পরিবারকে অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়।
মানবিক সংকট
মৃতদেহ আটকে রাখলে—
- পরিবার মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে।
- দাহ বা কবর দেওয়ার ধর্মীয় আচার বাধাগ্রস্ত হয়।
- মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
আইনি দিক
ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুযায়ী—
- মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখানো প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
- দেহ আটকে রাখা মানবাধিকারের পরিপন্থী।
আগে কী হত?
অনেক বেসরকারি হাসপাতাল মৃত্যুর পর পরিবারের হাতে বিশাল অঙ্কের বিল তুলে দিত।
- টাকা মেটানো না হলে মৃতদেহ ছাড়া হত না।
- এর ফলে পরিবার চরম দুশ্চিন্তায় পড়ত।
- অনেক সময় খবর প্রকাশ পেত—পরিবার মরিয়া হয়ে টাকা জোগাড় করছে, কেবল দেহ ফেরত পেতে।
এই ধরণের ঘটনা সমাজে বারবার বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
স্বাস্থ্য কমিশনের ভূমিকায় বদল Health Commission guideline
স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল—রোগী ও পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করা। এবার কমিশন তার ভূমিকা আরও স্পষ্ট করল।
- নির্দেশিকাটি কেবল হাসপাতালের জন্য নয়, নার্সিংহোম ও অন্যান্য বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্যও প্রযোজ্য।
- কমিশনের বক্তব্য—চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবসা হলেও, তা কখনও মানবিকতা ও নৈতিকতার ঊর্ধ্বে যেতে পারে না।
চিকিৎসক মহলের প্রতিক্রিয়া Health Commission guideline
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন—
- এই সিদ্ধান্ত পরিবারকে স্বস্তি দেবে।
- তবে হাসপাতালগুলিকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে।
- অনেক সময় পরিবার ইচ্ছে করেও বিল মেটাতে পারে না, তখন হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, আরেকটি অংশ মনে করছে—
- অর্থের জন্য দেহ আটকে রাখা সত্যিই অমানবিক।
- কমিশনের নির্দেশ মানবিকতার পক্ষে সঠিক পদক্ষেপ।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই এই নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছে বহু মানুষ।
- কেউ লিখেছেন—“অবশেষে হাসপাতালের দাদাগিরির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ।”
- আরেকজন লিখেছেন—“আমাদের যন্ত্রণা বোঝার জন্য ধন্যবাদ।”
- অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে বেসরকারি হাসপাতালের ‘অর্থলোভী’ ভাবমূর্তি বদলাতে পারে।
অন্যান্য রাজ্যে পরিস্থিতি Health Commission guideline
ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতেও একই সমস্যা বহুবার সামনে এসেছে।
- দিল্লি, মহারাষ্ট্র, কেরল—সব জায়গায় অভিযোগ উঠেছে মৃতদেহ আটকে রাখার।
- কেরলে কয়েক বছর আগে আদালতও রায় দিয়েছিল—দেহ আটকে রাখা যাবে না।
- এবার পশ্চিমবঙ্গও স্পষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে উদাহরণ তৈরি করল।
আইন ও মানবাধিকার বিশ্লেষণ
আইন কী বলে?
- ভারতীয় দণ্ডবিধি (IPC) অনুযায়ী মৃতদেহের অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
- কোনও হাসপাতাল মৃতদেহ আটকে রাখলে, তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ
জাতিসংঘও ঘোষণা করেছে—মৃত্যুর পরও মানুষের মর্যাদা অটুট রাখতে হবে।
অতএব, হাসপাতালের এমন আচরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।
ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন হতে পারে? – Health Commission guideline বিশ্লেষণ
স্বাস্থ্য কমিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী এখন থেকে রোগীমৃত্যুর পর দেহ আটকে রাখা যাবে না, সর্বোচ্চ ৩ ঘণ্টার মধ্যে দেহ পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। এই নিয়ম বাস্তবায়ন হলে নিঃসন্দেহে একাধিক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তবে সঙ্গে আসবে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জও। একদিকে যেমন পরিবারকে সম্মান ও মানবিক সহায়তা দেওয়া সহজ হবে, অন্যদিকে হাসপাতালের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকিও থেকে যাবে। এই পরিবর্তনগুলিকে আমরা কয়েকটি ভাগে বিশ্লেষণ করতে পারি।
১. পরিবার ও সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন Health Commission guideline
- দ্রুত দেহ পাওয়ার সুবিধা: এখন আর পরিবারকে অর্থসংকটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসপাতালে অপেক্ষা করতে হবে না। মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টার মধ্যেই তারা দেহ পেয়ে যাবেন।
- ধর্মীয় আচার পালনে স্বাধীনতা: বিভিন্ন ধর্মে মৃত্যুর পর দ্রুত দাহ, কবর বা অন্যান্য আচার পালনের নিয়ম আছে। দেহ আটকে থাকলে সেই আচার পালন ব্যাহত হত। এবার সেই সমস্যার অবসান হবে।
- মানসিক স্বস্তি: পরিবারের ওপর মৃত্যু নিজেই বিশাল মানসিক আঘাত। তার সঙ্গে যদি দেহ আটকে রাখা হয়, তবে কষ্ট দ্বিগুণ হয়। এখন সেই যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্তি পাবেন।
২. হাসপাতালের ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন Health Commission guideline
- বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষ অনেক সময় মনে করেন, বেসরকারি হাসপাতাল শুধু অর্থের জন্য কাজ করে। এবার এই নিয়ম কার্যকর হলে মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়বে যে হাসপাতালও মানবিকতার দিকটি গুরুত্ব দিচ্ছে।
- অভিযোগ কমবে: এতদিন বহু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে খবর এসেছে—“টাকার জন্য দেহ আটকে রাখা হয়েছে।” এখন সেই ধরনের নেতিবাচক প্রচার অনেকটাই কমবে।
- প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উন্নত হবে: দীর্ঘমেয়াদে হাসপাতালের ইমেজ উন্নত হবে, যা চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৩. আইনি ও প্রশাসনিক দিক Health Commission guideline
- আইনি জটিলতা কমবে: পরিবার হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করত দেহ আটকে রাখার জন্য। এবার তা কমবে।
- কমিশনের কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হবে: এই নির্দেশিকা কার্যকর হলে স্বাস্থ্য কমিশনের ক্ষমতা আরও দৃঢ় হবে। মানুষ বুঝতে পারবে যে কমিশন তাদের পাশে আছে।
- মানবাধিকার রক্ষা: মৃতদেহের মর্যাদা রক্ষা করা মানবাধিকারের অংশ। এই নিয়ম আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৪. সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ Health Commission guideline
যদিও অনেক ইতিবাচক দিক আছে, তবুও বাস্তব ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
(ক) হাসপাতালের বকেয়া টাকা আদায়ের সমস্যা
- মৃত্যু পরবর্তী সময়ে অনেক পরিবার বিল মেটাতে দেরি করে বা মেটাতে চায় না।
- আগে দেহ আটকে রাখার মাধ্যমে চাপ তৈরি করা যেত। এখন সেই সুযোগ আর নেই।
- এর ফলে হাসপাতালের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়বে।
(খ) ইচ্ছাকৃত প্রতারণার ঝুঁকি
- কিছু পরিবার ইচ্ছে করে টাকা না মেটাতে পারে।
- পরে তাদের খুঁজে বের করে টাকা আদায় করা আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় নিতে পারে।
(গ) ছোট নার্সিংহোমগুলির সমস্যা
- বড় হাসপাতালের তুলনায় ছোট নার্সিংহোম আর্থিকভাবে বেশি অসহায়।
- তারা যদি বারবার টাকা না পায়, তবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
৫. সম্ভাব্য সমাধান Health Commission guideline
এই চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলায় একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
(ক) স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার প্রসার
- যত বেশি সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আসবেন, তত কম সমস্যা হবে।
- বিমা কোম্পানি বিল মেটানোর দায়িত্ব নিলে পরিবার ও হাসপাতালের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমে যাবে।
- সরকারের উদ্যোগে সুলভ স্বাস্থ্যবিমা চালু করা উচিত।
(খ) আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা
- হাসপাতালের বকেয়া টাকা দ্রুত আদায়ের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট চালু করা যেতে পারে।
- কমিশন বা স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করার নিয়ম করা দরকার।
(গ) সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা
- প্রয়োজনে সরকার বিশেষ তহবিল গড়ে তুলতে পারে, যেখান থেকে হাসপাতালকে সাময়িক অর্থ দেওয়া হবে।
- পরে পরিবার থেকে সেই টাকা আদায় করা যেতে পারে।
(ঘ) প্রযুক্তির ব্যবহার
- সমস্ত হাসপাতাল বিল অনলাইনে নথিভুক্ত হলে পরিবার ও হাসপাতাল উভয়ের জন্যই স্বচ্ছতা থাকবে।
- সরকার নির্দিষ্ট ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করতে পারে, যেখানে মৃত্যু-পরবর্তী বিল মেটানো সহজ হবে।
৬. দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক পরিবর্তন Health Commission guideline
এই নির্দেশিকা কার্যকর হলে শুধুমাত্র হাসপাতাল ও রোগী পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক নয়, সমাজের মানবিক মূল্যবোধও আরও শক্তিশালী হবে।
- মানবিকতা বনাম বাণিজ্য: চিকিৎসা পরিষেবায় মানবিকতার জায়গা বাড়বে, বাণিজ্যিক মানসিকতা কমবে।
- মানুষের আস্থা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষ হাসপাতালকে আর ‘অর্থলোভী’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে শিখবে।
- সামাজিক ন্যায়: দুর্বল ও গরিব পরিবারও মর্যাদার সঙ্গে তাদের প্রিয়জনকে শেষ বিদায় জানাতে পারবে।
স্বাস্থ্য কমিশনের এই নির্দেশিকা একদিকে যেমন মানবিকতার জয়, অন্যদিকে হাসপাতালের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। পরিবার দ্রুত দেহ পাবে, ধর্মীয় আচার পালনে সুবিধা হবে এবং আইনি জটিলতা কমবে—এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। তবে হাসপাতালের বকেয়া টাকা আদায় ও আর্থিক ক্ষতির প্রশ্নটি থেকে যাবে।
এর সমাধান হবে—স্বাস্থ্যবিমা প্রসার, শক্তিশালী আইনি কাঠামো, সরকারের সক্রিয় ভূমিকা ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার।
সামগ্রিকভাবে, এই নিয়ম কার্যকর হলে সমাজে একটি বার্তা যাবে—মানবিকতার ঊর্ধ্বে অর্থ নয়। মৃত্যু-পরবর্তী মর্যাদা সবার মৌলিক অধিকার।
Health Commission guideline
স্বাস্থ্য কমিশনের এই নির্দেশিকা নিঃসন্দেহে মানবিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
“রোগীমৃত্যুর পর টাকার জন্য দেহ আটকে রাখা যাবে না”—এই নীতি শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, সমাজে মানবিকতার জয়গান।
এই পদক্ষেপের ফলে পরিবারগুলি দুঃসময়ে অন্তত একটি বড় কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। তবে, একইসঙ্গে হাসপাতালের আর্থিক নিরাপত্তার দিকটিও ভাবা জরুরি। অর্থ ও মানবিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
One thought on “রোগীমৃত্যুর পর টাকার জন্য দেহ আটকে রাখা যাবে না! কতক্ষণের মধ্যে পরিবারকে দেহ দিতে হবে, সময় বেঁধে দিল স্বাস্থ্য কমিশন”